সারা ব্লেইকলি | শেইপওয়্যার দিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়িক জগতের নক্ষত্র

নারীরা আজকাল পিছিয়ে নেই কোনো ক্ষেত্রেই। হোক সেটা লেখাপড়া, বিজ্ঞান বিষয়ক কিংবা ব্যবসা। আমরা যদি একটু ভালো করে খোঁজ নিই তাহলে দেখতে পারবো বর্তমান বিশ্বে যত বড় বড় কোম্পানি আছে, উদ্যোক্তা আছেন তাদের মধ্যে নারীদের আনাগোনা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। নারীরা তাদের বুদ্ধি, দক্ষতা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে হাজার বাঁধা স্বত্তেও নিজেদের অবস্থান নিয়েছেন অন্য এক উচ্চতায়। আজ এমনই একজন নারীর কথা জানবো যিনি একদম শূন্য থেকে শুরু করে নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করেছেন। চলুন আজকে পরিচিত হই নারী উদ্যোক্তাদের সম্রাজ্ঞী সারা ব্লেইকলি’র সাথে। যিনি উদ্যোক্তা শব্দটিকে নিয়ে গেছেন অন্য এক মাত্রায়।

সারা ব্লেইকলি- নারী উদ্যোক্তাদের সম্রাজ্ঞী

কথায় আছে, “প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক”- সারা ব্লেইকলি তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাববোধ করে বিরক্ত হয়েই সারা হঠাৎ করে আবিষ্কার করে ফেলেন তার “শেইপওয়্যার”। যা তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি, ঠিক তেমনটাই হলো এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে। তিনি হয়ে উঠলেন সেরাদের সেরা।

জন্ম ও ছোটবেলা

সারা ব্লেইকলির জন্ম ১৯৭১ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারী, আমেরিকার ফ্লোরিডার ক্লিয়ারওয়াটার শহরে। তার ছোটবেলাটা ছিলো সাধারণ তবে সংগ্রামের। ব্লেইকলির বাবা মায়ের ডিভোর্স অনেক অল্প বয়সেই তাকে আর্থিক সংগ্রামে ফেলে দেয়। বলা যায়, এই কঠিন পরিস্থিতিটাই তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার

সারা ব্লেইকলি ক্লিয়ারওয়াটার হাই স্কুল থেকে পাশ করেন এবং ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কমিউনিকেশনের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রী নেন। ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন তিনি ত্রি ডেল্টা ওমেন্স ইউনিয়নের (Delta Delta Delta (ΔΔΔ)) সদস্য ছিলেন। যদিও ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন, তবে ল’ স্কুলে রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় তিনি লক্ষ্য পরিবর্তন করেন। এরপর ওয়ার্ল্ড ডিজনিতে মাত্র তিন মাসের জন্য চাকরী করেন। ওয়ার্ল্ড ডিজনীতে চাকরীরত অবস্থায়ই সারা ড্যাংকা নামের কোম্পানিতে সেলসপারসন হিসেবে চাকরী পান। ড্যাংকা মূলত অফিসের কাজের জিনিসপত্র সাপ্লাইয়ের কোম্পানি ছিলো। সারা ঘরে ঘরে যেয়ে ফ্যাক্স মেশিন বিক্রি করতেন। এই কাজটি সারাকে কাস্টোমার সামলানো এবং জিনিস বিক্রির ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সাহায্য করে। এই কাজে তিনি এতটাই সফলতা অর্জন করেন যে মাত্র ২৫ বছর বয়সে “জাতীয় সেলস কোচ” হিসেবে সম্মানিত হন।

ত্রি ডেল্টা

ইউরেকা মোমেন্ট!

স্প্যানক্স- গ্রাউন্ডব্রেকিং এই শেইপওয়্যার ব্র্যান্ড যা শেইপওয়্যার ইন্ড্রাস্ট্রিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে, এর শেকড় ছিলো একটি ব্যক্তিগত ঘটনা। সারা একদিন কোনো একটি পার্টিতে যাওয়ার সময় আবিষ্কার করেন যে তার যে ধরনের ইনারওয়্যার প্রয়োজন, তা নেই। তারপর পুরোনো একটি ইনারওয়্যারকে কেটে প্রয়োজনীয় শেইপ করে তিনি পরেন। এই ঘটনা থেকে তিনি উদ্বুদ্ধ হন, এবং মাথায় আসে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রোডাক্ট আইডিয়ার- শেইপওয়্যার। একটি হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে শুরু হয় একটি বিশ্বজয় করা আইডিয়ার, যার মাধ্যমে হাজার নারীদের নিত্যদিনের একটি ঝামেলার অবসান ঘটে।

স্প্যানক্স এর শুরু

মাত্র ২৭ বছর বয়সে সারা তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় ৫০০০ ডলার নিয়ে চলে আসেন আটলান্টায়। এখানে তিনি নিজে একটি ইনারওয়্যার মডেল তৈরী করেন এবং এটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন। এক বছর ধরে কাজ করার পর তিনি একটি মডেল দাঁড় করান এবং তার পরিবার ও বন্ধুদেরকে দিয়ে এটি পরীক্ষা করেন। সারা আবিষ্কার করেন বাজারের প্রচলিত ইয়ারওয়্যারগুলো খরচ কমাতে সবই একই শেইপ ও সাইজের। তাই তিনি নতুনভাবে বিভিন্ন শেইপ এবং সাইজের ইনারওয়্যার তৈরী করেন যেন তা সকলের জন্য সমান কার্যকরী হয়।

২০০০ সালে সারা “স্প্যানক্স” ব্র্যান্ড এর কাজ অফিসিয়ালি শুরু করেন তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। এ সময় তার বন্ধু তাকে সাহায্য করতে নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার সাথে ব্যবসা পরিচালনার কাজে যোগ দেন। এই কাজটি শুরুর আগে সারা আমেরিকার বিখ্যাত রিটেইল কোম্পানি নেইম্যান মার্কাস গ্রুপের সাথে একটি মিটিং করেন। যেখানে তিনি কাস্টমারদের সামনে তার এই পণ্যটি দেখান এবং সুবিধা অসুবিধা তুলে ধরেন। এই মিটিং এর ফলাফল স্বরূপ, স্প্যানক্স শুরুর পর থেকে নেইম্যান মার্কাস এর সাতটি দোকানে স্প্যানক্স এর ইনারওয়্যার বিক্রি শুরু হয়।

ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে সাফল্যের শিখায় উত্তরণ

স্প্যানক্স শুরুর রাস্তাটা এতটা মসৃণও ছিলো না। বার বার অনেক ইনভেস্টর, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় সারার এই আইডিয়াটি। তবে সারা কখনোই হতাশ হন নি, বরং আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়েছেন। সারার আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতা, তার এই কোম্পানিটিকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। সারা নারী বলেই তার এই আইডিয়াকে অনেকেই আমলে নেয়নি। এসকল প্রতিকূলতা সারাকে আরো বেশি দৃঢ় করে তুলেছে।

স্প্যানক্স- সারা ব্লেইকলি

স্প্যানক্স এর সাফল্যের পেছনে মার্কেটিং এর একটি স্ট্র্যাটেজি- “ওয়ার্ড অফ মাউথ” অর্থাৎ মুখে মুখে প্রচারণার দারুণ একটি অবদান রয়েছে। মূলত স্প্যানক্স এর ইনারওয়্যার এর কাস্টমাররা নিজেরাই নিজেদের পরিচিত অন্যান্য নারীদেরকে এটির সুবিধা বলতে শুরু করে আর কিনতেও উৎসাহ দেয়। এভাবে করে আস্তে আস্তে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার উপর অপরাহ উইনফ্রে এর মতো সেলিব্রিটিরাও যখন এটি নিয়ে পজেটিভ ধারণা দেয়, তখন স্প্যানক্স এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।

সবচেয়ে কম বয়সে সেলফ মেইড বিলিওনিয়ার হওয়া

সারা ব্লেইকলি সবচেয়ে কম বয়সে সেলফ মেইড বিলিওনিয়ার হয়েছেন। ২০১২ সালে ফোর্বস তাকে এ স্বীকৃতি দেয়। এই ঘটনা থেকেই আমরা বুঝতে পারি তার এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস কতটা শক্তিশালী ছিলো।

চ্যারিটি ও নারী ক্ষমতায়নে সারার ফাউন্ডেশন

সারা শুধুই বিলিওনিয়ার হয়ে বসে থাকেননি, বরং ২০০৬ সালে তিনি নারীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরীর জন্য গঠন করেন “সারা ব্লেইকলি ফাউন্ডেশন”। এ ফাউন্ডেশন এর শুরুতেই আরেকজন বিশ্বখ্যাত নাম করা উদ্যোক্তা রিচার্ড ব্র‍্যানসন সারার পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন এবং ৭,৫০,০০০ ডলার দান করেন ফাউন্ডেশনটি চালু করার জন্য।

চালু করার পর থেকেই ফাউন্ডেশনটি দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিটি অ্যান্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সিটি ক্যাম্পাসে নারীদের জন্য বৃত্তি দিয়েছে। সারা ২০০৬ সালে দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো-তে উপস্থিত হয়েছিল, তিনি লিডারশিপ একাডেমিতে ১ মিলিয়ন ডলার দান করেন। এছাড়াও তিনিই প্রথম নারী বিলিওনিয়ার যিনি “গিভিং প্লেজ” এ চুক্তিবদ্ধ হন, যেটি মূলত বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেটের মেয়ে শিশুদের জন্য করা একটি প্রকল্প, যেখানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা তাদের সম্পত্তির অর্ধেক দাতব্য কাজে দান করে থাকেন। এছাড়াও ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে একটি নিলামের মাধ্যমে তিনি জন নিউটন ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য ১,৬২,৫০০ ডলার প্রদান করেন। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের মহামারি চলাকালীন ৫,০০০,০০০ ডলার প্রদান করে ছোট ছোট নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা চালানোর জন্য।

সারা ব্লেইকলি

বর্তমানে স্প্যানক্স

স্প্যানক্স কখনো অফিসিয়ালি সেভাবে তাদের আর্থিক তথ্য জানায়নি। ফোর্বস ২০১৪ সালে এর মূল্য অনুমান করেছে প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন ডলার। এর সম্পূর্ণ মালিকানা সারা ব্লেইকলি এর এবং তিনিই সিইও। স্প্যানক্স এ বর্তমানে শুধুই নারীদের ইনারওয়্যার নয় বরং পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই নানারকম ইনারওয়্যার, শেইপওয়্যার, সুইম স্যুট, ম্যাটারনিটি ওয়্যার তৈরী করে থাকে। স্প্যানক্স সারা বিশ্বে ৫০টিরও বেশি দেশে পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে থাকে। স্প্যানক্স এর একটি মজার বিষয় হলো- এর যেকোনো পণ্য আগে এর কর্মীদেরকে পরীক্ষামূলকভাবে দেয়া হয়। সেটির ফলাফল ভালো ও আরামদায়ক হলেই পণ্যটি পরবর্তীতে বিক্রির জন্য তৈরী করা হয়। বর্তমানে কোম্পানিটিতে ১০০ এরও অধিক কর্মী নিয়োজিত আছে।

সারা ব্লেইকলির কথা

এই অত্যন্ত সফল মানুষটি কিন্তু জীবনে বহু বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন তবে থেমে থাকেননি। তিনি বলেন, “আমার বাবা আমাদেরকে ব্যর্থ হতে উৎসাহিত করতেন। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতেন আমরা একটি সপ্তাহে কীসে কীসে ব্যর্থ হয়েছি। যদি কিছু না থাকতো, তিনি হতাশ হতেন। এটি অল্প বয়সে আমার মানসিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। আমি জেনে গিয়েছিলাম যে ব্যর্থতা ফলাফল নয়। বরং চেষ্টা না করাটাই চূড়ান্ত ব্যর্থতা। তাই ব্যর্থ হতে ভয় পাবেন না।“

তিনি আরো বলেছেন, “আপনি যা জানেন না তা ভয় পাবেন না। এটি হতে পারে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। তারচেয়ে আপনি এটি নিশ্চিত হন যে, আপনি সবার থেকে আলাদাভাবে কাজ করেন।”

সারা ব্লেইকলি আমাদের সবার জন্য সফলতার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি কোনো বাঁধাতেই কখনো থামেননি, হতাশ হননি। বরং ব্যর্থতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, যার ফলে পেয়েছেন আকাশ সমান সফলতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *