মি টাইম বা নিজের জন্য সময় বের করবেন কীভাবে?

নিজের জন্য সময় বের করা এবং করাটা গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটার সাথেই মানুষজন খুব একটা অভ্যস্ত না। মনে হতে পারে আলাদা করে আবার নিজের জন্য সময় বের করার কী আছে? পরিবারের সদস্য এবং অফিসে কলিগদের সাথে ভালো সময় কাটাচ্ছি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি এতকিছু তো নিজের আনন্দের জন্যই করছি। তাহলে আবার আলাদা করে নিজের জন্য সময় বের করতে হবে কেন? এই জায়গাটাতেই আমরা আমাদেরকে কম গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। মি-টাইম বা একান্তই নিজেরও যে উপভোগ করার, চিন্তাভাবনা করার সময় দরকার হতে পারে এটা আমরা বুঝতেই চাই না। এটা অনেকটা জেনারেশনেরও ব্যাপার। আমাদের আগের প্রজন্ম যারা আছেন তাদেরকে আমরা দেখেছি তার কাছের মানুষদের ঘিরেই তার জীবনের সব আনন্দ, সুখ। কাছের মানুষ, পরিবারের মানুষ ভালো থাকলেই তারা সবচেয়ে সুখী বোধ করেন। যদি আমাদের প্রজন্মের কথা আসে বলা যায় আস্তে আস্তে এই ব্যাপারটায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই প্রজন্মের মানুষেরা নিজেদের খুশি নিয়েও সচেতন হচ্ছেন, চিন্তাভাবনা করছেন, একান্ত নিজের জন্য সময় বের করার ব্যাপারে সচেতন হচ্ছেন।

মি টাইম কী? 

সবকিছুর বাইরে সব ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে নিজের চিন্তাজগতকে প্রসারিত করা, নিজের সবকিছু নিয়ে উপলব্ধি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা, নিজের যত্ন নেয়া, নিজের শখের মূল্য দেয়া, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার মতো কাজগুলোই হচ্ছে মি-টাইম অ্যাক্টিভিটি। অর্থাৎ কোনো ধরনের কোনোকিছুর সাথে আপোস না করে সম্পূর্ণ সময় এবং প্রচেষ্টা নিজের জন্য দেয়াটাই আসলে মি-টাইম, যেটা একান্তই নিজের।

আপনি যখন একাকী একদম নিজের মতো সময় কাটাবেন তখন আপনার চিন্তাজগতের প্রসারতা তৈরি হবে, এতে করে আপনি নিজেকে জানার ও বোঝার সময় পাবেন। নিজের চাহিদা বা চিন্তাধারা অনুযায়ী পরবর্তীতে যেকোনো কাজ করতে পারবেন। আশেপাশের মানুষ, বন্ধু, পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্কের টানাপোড়েন, বোঝাপড়াগুলো আপনি মন দিয়ে আরো ভালো করে বুঝতে শিখবেন, সেগুলোর ভুল-ত্রুটি নিয়ে কাজ করবেন, এতে করে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত হবে। জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে পারবেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, মি-টাইম কাটানোর বেশ কিছু ভালো দিক রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়া। আপনি যখন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে খুব ভালো করে জানতে পারবেন তখন যেকোনো কাজ করতে, যেকোনো কঠিন মূহুর্তে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে, যেকোনো কঠিন ঝামেলা মোকাবিলা করতে আপনার কারো উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। আপনার নিজ সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিহানও থাকতে হবে না। এছাড়াও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আরো পারদর্শী হয়ে উঠবেন।

মে টাইম

মি টাইম বের করবেন যেভাবে

১) নিজের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হওয়া  

এই মূহুর্তে কোন কাজটি নিজের জন্য করা দরকার, কোন জিনিসটি দরকার সেটা আপনি ছাড়া কেউ জানবে না। তাই আপনাকেই নিজের চাহিদা প্রকাশ করতে হবে এবং সেগুলো পূরণে সচেতন হতে হবে। আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের অবগত করে দিতে হবে এ ব্যাপারে। অর্থাৎ যখন আপনি একান্তই নিজের মতো সময় কাটাতে চাচ্ছেন, সেখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ আপনি আশা করছেন না। সেই অনুযায়ী আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে নিতে পারেন, সেটি খাবার কিছু হতে পারে, শখের যেকোনো জিনিস হতে পারে, শারীরিক যত্নের কোনো উপকরণ হতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সাহায্য করবে এমন কিছু হতে পারে।

২) আত্মসমালোচনা করা

আপনি যখন দিনের কোনো একটা সময় বা সপ্তাহের কোনো একটা সময়ে আপনার কাজ, আচরণ, অন্যের ব্যাপারে আপনি কখন কেমন ধারণা পোষণ করেন এই ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন বা আত্মসমালোচনা নিজেই করবেন তখন নিজেই নিজের ভালো ও খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন। পরিবারের সদস্য হিসেবে আপনি কেমন, বন্ধু হিসেবে কতটুকু সহনশীল, প্রতিবেশী হিসেবে কতটুকু সামাজিক, অভিভাবক হিসেবে কতটুকু দায়িত্বশীল, কলিগ হিসেবে কতটুকু আন্ডারস্ট্যান্ডিং এমন সবকিছুই।

এতে আপনার নিজের ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করতেও সুবিধা হবে, নিজেকে একজন সামাজিক ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। এছাড়াও মি টাইমের কারণে আপনার আভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো আরো পরিষ্কার হবে। যেমন- কোনো কাজের জন্য আপনি অপরাধবোধে ভুগছেন কি না, কোনো কাজে আপনি অনুতপ্ত কি না, কোনোভাবে নিজের সাথে অবিচার হচ্ছে এমন মনে হচ্ছে কি না।

৩) জোর করে ‘হ্যাঁ’ না বলা

কখনো সম্পর্কের দায়বদ্ধতা বা টানাপোড়েন থেকে যে কাজটা আপনার পক্ষে করা সম্ভব না সেই কাজ করতে যাবেন না। সময় অনেক মূল্যবান এবং যে সময় চলে গেছে তা কখনো ফিরে পাওয়াও সম্ভব না। যেকোনো ধরনের সম্পর্কেই আপোস দরকার তবে অপর পাশের মানুষকেও আপনার বোঝাতে হবে যে আপনার মতামত বা সময়ের গুরুত্ব তারও দেয়া উচিত। সবসময় সবকিছুতে সহমত প্রকাশ করাও নিজের সাথে অন্যায় করার মতো ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের কাজ এবং জীবনকে গুরুত্ব দিয়েই অন্যের কাছ থেকে কিছু আশা করা উচিত এবং কোনোকিছু চাপিয়ে জোর করে না করানো উচিত। যখন আপনি নিজের সময়ের ব্যাপারে নিজের মতের ব্যাপারে সচেতন হবেন তখন আপনাকে এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখতে হবে। যেমন ধরেন আপনি কোনো দরকারি কাজে ঢুকছেন এমন সময় কেউ অন্য কোনো কাজ করে দিতে বললো তখন তাকে না বলতে শিখুন।

না বলতে শেখা

৪) একা ঘুরতে যাওয়া

সবসময় পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা অন্যকারো সাথে ঘুরতে যেতে হবে এমনটা নাও হতে পারে। আপনি চাইলে নিজে একা একাও কোথাও যেতে পারেন। যখন একা একা কোথাও যাবেন, আপনি আপনার নিজেকে ক্যারি করার অ্যাবিলিটি সম্পর্কে জানতে পারবেন যে একা কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে সেটা আপনি কতটা মোকাবিলা করতে সক্ষম। বুঝতে পারবেন আপনি একা একা কতটুকু নিজের সঙ্গ উপভোগ করছেন। নিজের সাথে দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্য একা ঘুরতে যাওয়া হতে পারে অনন্য হাতিয়ার।

৫) নিজের শখের কাজ করা

ধরুন আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন অথবা ছবি আঁকতে। কিন্তু আপনি জীবনের ব্যস্ততায় নিজের জন্য এতটুকু সময়ই বের করতে পারছেন না যে একাকী বসে এক কাপ কফি খেতে খেতে একটি বই পড়বেন। এই সময়টা বের করে সুন্দর একটু সময় কাটানোর কথাই বলে মি-টাইমে। যা খুব মন থেকে করতে আমরা পছন্দ করি সেটিকেই মূলত শখ বলে। তাই যখন মন থেকে কোনোকিছু আমরা করতে চাইবো, আনন্দ পাবো তখন সে কাজটা করার মাধ্যমে নিজের মানসিক সুখের ব্যবস্থা করা, একটু শান্তির সময় কাটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই যে কাজগুলো মনে সুখের খোরাক জোগায় এমন কাজগুলো করার জন্য অন্তত সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট সময় খুঁজে বের করা উচিত।

৬) ব্যায়ামের অভ্যাস তৈরি করা

ব্যায়াম বা ইয়োগার মাধ্যমে শরীরের যে সঞ্চালন তৈরি হয় তার কোনো তুলনা হয় না। প্রতিদিন অন্তত একবার ১৫-২০ মিনিটের জন্য এক্সারসাইজ করার ব্যাপারে সব মানুষেরই সময় বের করা উচিত, শারীরিক ক্লান্তি, শরীরকে সচল রাখা, রক্ত চলাচল ভালো করা ছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও এই কাজগুলো খুবই উপকারী। মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, চিন্তা ও মানসিক চাপ থেকে বের হয়ে আসার জন্য ইয়োগা সব থেকেই বেশি কার্যকর। এছাড়াও মানসিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, চঞ্চলতা, অস্থিরতা কমিয়ে আনা ও স্মৃতিশক্তি ভালো করার জন্যও এটি ভালো ফলাফল দিতে পারে। তাই মি-টাইম রুটিনে অবশ্যই এক্সারসাইজ যুক্ত করা প্রয়োজন।

ব্যায়াম করা

৭) নিজের পছন্দের খাবার বানানো

পছন্দের খাদ্যতালিকা নেই বা কোনো নির্দিষ্ট পছন্দের খাবার নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। প্রায় সব মানুষই বিভিন্ন রকম খাবার পছন্দ করেন, অনেকে আবার ফুড এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন, বিভিন্ন অঞ্চল বা বিভিন্ন দেশের খাবার ট্রাই করতে পছন্দ করেন। কেউ কেউ আবার প্রচন্ড ভোজনরসিক। সত্যিকার অর্থে খাবার তো জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, খাবার খেলেই আমাদের শরীর শক্তি পায়, জীবনের চালিকাশক্তির মূল উৎস খাবার। তাই নিজের জন্য যে সময়টুকু আলাদা করে রাখবেন সে সময়ে যদি নিজের পছন্দমত খাবারও খাওয়া যায় তখন মি-টাইম টা আরো আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।

৮) সবকিছুর বাইরে ‘মি-টাইম’ ব্লক আউট করা

পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের বাইরেও নিজের জন্য সময় আগে থেকেই আলাদা করে রাখাই হলো মি-টাইম ব্লক আউট করা। মানুষ সামাজিক জীব। একজন ব্যক্তির কর্মজীবন থাকবে, সামাজিক, পারিবারিক জীবন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেসব জীবনে অনেক ধরনের দায়িত্ব দায়বদ্ধতা থাকবে। এই সবকিছুর পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যাতে নিজেদের কথা না ভুলে যাই, তাই আগে থেকেই নিজের জন্য কিছু সময় ব্লক আউট করে রাখা উচিত, যে সময়টা থাকবে একান্তই নিজের। সেখানে কোনো কর্মব্যস্ততা থাকবে না, পারিবারিক চাপ থাকবে না।

৯) ত্বকের যত্ন নেয়া

জাপান, সাউথ কোরিয়া, আমেরিকার মতো দেশগুলোর মানুষ ত্বকের যত্নের ব্যাপারে যতটুকু সচেতন, সেই তুলনায় আমাদের সচেতনতা অনেকটাই কম। অথচ ত্বকের যত্ন নেয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজের জন্য বের করা সময়ে ত্বকের যত্ন করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত সকাল রাতে দুইবার ত্বকের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। ত্বকের যত্নে সানস্ক্রিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যতকিছুই ব্যবহার করেন না কেন, সানব্লক দিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে না বাঁচালে কোনোকিছুই ফলপ্রসু হবে না। সেই সাথে সপ্তাহে অন্তত একবার ত্বকের ধরন অনুযায়ী ফেইসপ্যাক ব্যবহার করা উচিত। তাই মি-টাইম এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত ত্বকের যত্ন নেয়া। এতে আপনার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাবে।

ত্বকের যত্ন নেয়া

১০) কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা

একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে সকল ধরনের কর্মব্যস্ততা শেষ করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে, সেটা বাসার কাজ হোক বা বাইরের। কিছু নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে, গুছিয়ে কাজ করতে হবে। যাতে করে অগোছালোভাবে কাজ করার জন্য কোনো মানসিক অশান্তির সৃষ্টি না হয় বরং গুছিয়ে কাজ করে সময় বাঁচিয়ে সেই সময়টা নিজের জন্য দিয়ে নিজের উপর ইনভেস্ট করার প্রবণতা বাড়ানোই বেশি প্রয়োজন।

১১)পরিবার ও কাছের মানুষদের সাথে সময় কাটানো

পছন্দের মানুষদের সাথে একসাথে কিন্তু একা সময় কাটানো সম্ভব। এতে করে সবাই একা থাকবে, কিন্তু মনে হবে পছন্দের মানুষেরা কাছেই আছে। যেমন, বাসার সবাই মিলে আধাঘণ্টা চুপচাপ বই পড়তে পারেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে সুন্দর গান ছাড়তে পারেন। একটা মোমবাতি জ্বেলে কারো কাছে বসতে পারেন। সবাই সবার মতো বসে ছবি আঁকতে পারেন, ক্রাফটিং করতে পারেন, কিছু লিখতে পারেন। একা সময় কাটানোর সময় পার্টনারের কাছাকাছি থাকার সুবিধা আছে অনেক, যেমন তাতে ক্ষতিকারক কর্টিসল হরমোনের লেভেল কমে। তাই একা সময় সবসময় একাই হতে হবে, তা কিন্তু নয়।

১২) কিছু না করেও সময় কাটানো

সবসময় ফলপ্রসূ কাজ করতে হবে ব্যাপারটা এমন না। সবসময় কিছু একটা করতেই হবে এমনটাও কিন্তু না। কিছুই না করার মানে কিন্তু ফোন বা টেলিভিশন থেকেও দূরে থাকা। স্ক্রিন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে নিজের সাথে সুন্দর সময় কাটান। এক কাপ কফি বানান, গভীর দীর্ঘশ্বাস নিন, মন খুলে হাসুন।

নিজেকে সময় দেয়া

সবাইকে সময় দেয়ার গুরুত্ব আমরা যেভাবে বুঝি ও উপলব্ধি করি, নিজেকে সময় দেয়ার গুরুত্বও আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। নিজের ব্যাপারে যত্নশীল হয়ে পরম মমতায় নিজেকেও আগলে ধরা প্রয়োজন। নিজেকে সময় দেয়া প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *