ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স | সুন্দর জীবনের এক অনন্য হাতিয়ার

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা IQ শব্দটা অনেক বেশি শুনলেও EQ অথবা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এই শব্দের সাথে একটু কমই পরিচিত। মার্কেটিং রিলেটেড কাজের ক্ষেত্রেই বরং এই শব্দটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে যারা ট্রেনিং বা হিউম্যান রিসোর্স বিভাগে কাজ করেন তারা সবচেয়ে বেশি এই বিষয় নিয়ে কথা বলেন। যদিও এর প্রয়োগ আমাদের সমগ্র জীবন জুড়েই।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স 

EQ বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কী সেটা বোঝার জন্য ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক।

ধরুন সকালবেলা, অফিসে যাওয়ার আগে আপনি চা খাচ্ছেন এবং আপনার ছোট্ট মেয়ে গল্প করতে করতে চায়ের কাপটা আপনার কাপড়ের ওপর ফেলে দিল। সম্ভবত আপনি রেগে যাবেন, আপনার মেয়েকে বকাবকি করবেন, হয়ত আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গেও রাগারাগি করলেন যে কেন সে খেয়াল করেনি মেয়ের দিকে, কাপড় আবার ইস্ত্রি করে পরতে হবে এবং দেরি হবে। এর কারণে আপনি রাগের মাথায় হয়ত আপনার কিছু জরুরি কাগজ অফিসে নিতে ভুলে যাবেন, যাওয়ার সময় গাড়ি চালাতে যেয়ে আপনি তাড়াহুড়ো করে চালাচ্ছেন, স্পীড বেশি হওয়ার কারণে পুলিশের কাছ থেকে কেস পাওয়া ইত্যাদি কত ঘটনা। তারপর সারাদিন একটা খারাপ দিন পার করার পর, দিন শেষে বাড়ি ফিরে দেখলেন মেয়ের মুখ কালো, আপনার স্বামী বা স্ত্রী সেও কেমন যেন চুপচাপ।

ঘটনাটা অন্যভাবেও হতে পারত। কাপড়ে চা পড়ে যাওয়াটাকে তো আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু সারাদিনের বাকি বাজে ঘটনাগুলো হয়ত হত না, শুধুমাত্র যদি ঐ মুহূর্তের মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, যদি মেয়ের দিক থেকে ভাবা যেত, কারণ সে তো আর ইচ্ছে করে করেনি কাজটা। শুধু বললেই হতো, “ঠিক আছে, কিছু হয়নি। এরপর সাবধানে থেকো।”

এটা খুব পরিচিত উদাহরণ, বিখ্যাত ম্যানেজমেন্ট তাত্ত্বিক স্টিফেন কোভির কাছ থেকে নেয়া। নতুন উদাহরণ লিখতে যেয়েও এই উদাহরণকেই বেছে নিলাম, কারণ, “ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স” বিষয়টা ওনার এই উদাহরণে বেশি পরিষ্কার হয়।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স

মজার ব্যাপার হলো, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এই শব্দটা যারা হাতে কলমে জানেন না, তারাও কিন্তু প্রতিনিয়ত এর প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। EQ- এই শব্দটার সরাসরি বাংলা করলে দেখা যায় এর অর্থ দাড়ায়,’আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা আবেগ সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা’। সহজ ভাষায় বলা যায় EQ হলো, আমাদের ডেইলি লাইফে আবেগকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করে নিয়ন্ত্রণ করে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা। কথাটা যতটা সহজ বাস্তবে এই কাজ করা ঠিক ততটাই কঠিন। যদি এতটাই সহজ হতো, আশেপাশের জীবন অনেক সহজ হতো, আমাদের সবার সাথে সবার খুব ভালো সম্পর্ক ও বজায় থাকতো। রাগ, দুঃখ, হাসি, কান্না সবকিছুই আসলে আবেগের প্রকাশ। এই সবকিছুই আসলে জীবনের অংশ। কোনো একটিকে বাদ দিয়ে আমরা জীবন নিয়ে ভাবতে পারবো না। আমাদের যা করতে হবে তা হলো নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস। প্রায়ই আমরা দেখি, ভালোবেসে দুইজন বিয়ে করলেন, কিন্তু এখন এমন এক তিক্ততা তৈরি হয়েছে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। একটা বয়স পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছে সন্তানের খুবই কদর থাকে, তারা তাদেরকে বুঝতে চায়, তাদের সুবিধা অসুবিধা অনুযায়ী স্টেপ নেন। কিন্তু একটা সময়ের পর কেউই আর কারো ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে চান না, বাবা মাও এটা সেটা চাপিয়ে দেন, সন্তানও এটা সেটা আবদার চাপিয়ে দেন তাদের অবস্থান না বুঝেই। একটা বন্ধুর সাথে আগে অনেক দেখা হতো, আড্ডা হতো। এখন জীবনের ব্যস্ততায় সে আগের মতো আড্ডায় সময় দিতে পারছে না বলে আমরা অনেক সময়ই ব্যাপারটা পার্সোনালি নিয়ে নেই।

এতসব ইমব্যালেন্স এর কারণই হচ্ছে ল্যাক অফ ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। ইন্টেলিজেন্স যখনই আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখনই আমরা হয়ে যাই আবেগের দাস। তখন আমরা আবেগকে পরিচালনা করি না বরং আবেগ আমাদের পরিচালনা করে। আর তখনই করে ফেলি আমরা অযাচিত কোনো কাজ। সেটা অফিসে হতে পারে, বন্ধুদের সাথে হতে পারে, পরিবারের সাথে হতে পারে। যা ডেকে আনতে পারে আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনে বিড়ম্বনা। তাই এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ব্যাপারটা চর্চা করতে হবে।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স চর্চার ধাপ

এই ইন্টেলিজেন্স চর্চার চারটি ধাপ হতে পারে। সেগুলো হচ্ছে-

নিজেকে চেনা ও বোঝা বা আত্মসচেতনতা (Self-awareness)

বোঝার চেষ্টা করুন যে আপনার বিভিন্ন আবেগসংক্রান্ত দিকগুলো। আমাদের আবেগগুলোকে যদি ৫টি মূল ভাগে ভাগ করি, তাহলে তারা হবে আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, ভয় এবং রাগ (পল একম্যান এর তত্ত্ব অনুযায়ী)। যারা পিক্সার (Pixar) এর “ইনসাইড আউট” (Inside Out) সিনেমাটি দেখেছেন, তারা হয়ত এদের সঙ্গে পরিচিত। চিনতে চেষ্টা করুন আপনার ভিতরের এই ৫ চরিত্রকে। এরা কোন পরিস্থিতিতে কীরকম আচরণ করে, কোন ধরনের ঘটনা এদের মধ্যে কাকে উজ্জীবিত করে, এটা বোঝার চেষ্টা করুন। যখন এগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করে, কে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। যেমন মনে করুন- আপনি হয়ত সামান্যতেই রেগে যান, মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। বুঝতে চেষ্টা করুন, কী কী ঘটনা আপনাকে সহজেই রাগিয়ে দিচ্ছে বা দেয়। এই রাগ কি অন্য কোনো ঘটনার কারণে আপনার ভিতরে জমে আছে? কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজে কি এরকম লাগে আপনার? বুঝতে চেষ্টা করুন।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (সেলফ অ্যাওয়ারনেস)

নিজেকে ম্যানেজ করা (Self-management)

নিজেকে যদি বুঝতে শুরু করে থাকেন, তাহলে সে বুঝতে পারা বিষয়গুলো নিজেকে বার বার বোঝান। পরিস্থিতি ভালো খারাপ যাই হোক না কেন, খুঁজে পাওয়া কারণগুলো যেন আপনার আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে আর পাঠাতে না পারে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকার চর্চা করুন। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে, অনেক ক্ষেত্রেই পেরে উঠবেন না। ধৈর্য ধরুন, চেষ্টা করুন, এক সময় ম্যানেজ করতে পারবেন।

অন্যদেরকে বা সমাজকে বোঝা (Others or social awareness)

মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব। অন্যরা বলতে আসলে এখানে নিজেকে বাদে বাকি সবাইই চলে আসে। স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু। এরা ছাড়াও সামাজিক জীবনে আমাদের আরো অনেক মানুষের সাথে ডিল করতে হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্য আছেন, প্রতিদিনের জীবনে আমি যাদেরকে ঘিরে জীবন পরিচালনা করি তারা সবাই আমাদের এই সামাজিক জীবনের অংশ। শুধুমাত্র আমরা আমাদের কাছের লোকদের কথা ভাববো, সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহী থাকবো না তাহলে তো টিকে থাকা মুশকিল। যেকোনো সোশ্যাল গ্যাদারিং এ কীভাবে আচরণ করতে হবে, একটা সামাজিক সমস্যায় সমাধানে কীভাবে নিজেকে বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের অবস্থান জানান দিতে হবে, সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এই সবই সামাজিক জীবনের অংশ এবং মেইনটেইন করার বিষয়। এগুলো যত গুছিয়ে করতে পারবো, উত্তেজনাপূর্ণ মুহুর্ত যত ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো ততই সামাজিক জীবন কল্যাণের হবে।

সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস

 

সম্পর্ক বা সমাজকে ম্যানেজ করা (Relationship or social management)

এই অংশটাই আসলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এর মূল হাতিয়ার। যখনই আপনি আপনাকে কেন্দ্র করে ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে বুঝতে শুরু করবেন, তাদেরকে নিয়ে ভাববেন ঠিক তখনই তাদের সাথে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। আপনি যখন দেখবেন আপনার বন্ধুটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, আপনি ঠিক কীভাবে কী করলে তাকে ভালো অনুভূতি দেয়া যাবে, কী বললে সে এই মুহুর্তে কষ্ট পাবে না, আপনার অফিস কলিগ কোন কথায় কষ্ট পাচ্ছেন, আপনার স্ত্রী/স্বামী আপনার থেকে ঠিক কী ধরনের আচরণ আশা করছেন, আপনার সন্তানেরা আপনার সাথে কতটুকু স্পেস পাচ্ছেন এগুলো আপনি যত তাড়াতাড়ি রপ্ত করতে পারবেন, ঠিক তত তাড়াতাড়ি সম্পর্ক গুলো ভ্যালুয়েবল হবে এবং ভাঙনের থেকে দূরে থাকবে।

একজন ব্যাক্তির মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য আসলে ইমোশন দরকার। আমরা জানি মানুষের নেচারই আসলে ইমোশন দিয়ে বিল্ডআপ করা। আমাদের সবটা জুড়েই ইমোশনের প্রভাব। তাই এই অংশ নিয়ে মানুষ ভয়ে থাকে, বাদ দেয়ার আশা করে। বাদ না দিয়ে বরং নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে।ম্যা নেজ করা শিখতে হবে, কন্ট্রোল করা শিখতে হবে। তাহলেই জীবন সুন্দর হবে।

ছবিঃ সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *