ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি কী, কেন হয় এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

সকালে ঘুম থেক উঠে অফিসে যাচ্ছেন, সারাদিন কাজ করছেন, রাতে ফিরে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। পরদিন আবার একই রুটিন। কিন্তু দৈনিক এমন কাজের ভিড়ে না তো আপনার কোনো ভালোলাগা আছে, না নিশ্চিন্ত অনুভূতি। কাজ করতে করতেই আপনার মাঝে দুশ্চিন্তা ভর করে, আশেপাশের সবাইকে বিরক্ত লাগতে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি হয় চাকরি হারিয়ে যাওয়ার ভয়। এ ধরনের সমস্যা যদি আপনারও হয়ে থাকে, তাহলে জানুন এতে আপনি একাই ভুগছেন না। আপনার মতো আরও অনেকেই এ সমস্যায় ভুক্তভোগী। এই সমস্যাগুলোর নাম ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি। আজ আলোচনা করবো গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়েই।

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি কী?

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি আরও পরিচিত অকুপেশনাল অ্যাংজাইটি বা ওয়ার্ক রিলেটেড অ্যাংজাইটি নামে। ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট বা জবে সাধারণত এই ধরনের অ্যাংজাইটিগুলো লোকেরা ফেইস করে থাকেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জব রোলে কর্মরত কর্মীরা কমন এই প্রবলেমটি ফেইস করেন।

নানাভাবে নানা ঢং এ এই অ্যাংজাইটির দেখা মেলে। কখনো অতিরিক্ত চিন্তা করা, টেনশন, ওয়ার্ক রিলেটেড কাজ করতে যেয়ে ভয় পেলে, পারফরম্যান্স খারাপ হলে বা ডেডলাইন মিস করলে এই অ্যাংজাইটি প্রকট হয়। শুধু এই নামগুলোই নয়, এটি আবার পরিচিত সোশ্যাল অ্যাংজাইটি নামেও। এখানে ভয় থাকে কলিগ, ক্লায়েন্ট বা সুপারভাইজরদের দ্বারা জাজ হওয়ার। এতে প্রায় সময়ই ব্যক্তির প্যানিক অ্যাটাক হয়, মেন্টালি, ইমোশনালি বার্নআউট তো হয়ে যানই, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে ফিজিক্যালিও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি, আরফাতুন নাবিলা

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ব্যক্তির জীবনে এতটাই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যে তার সব ধরনের প্রোডাক্টিভিটি কমে যায় এবং জব পারফরম্যান্স খারাপ হতে থাকে। যারা এই সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ওয়ার্ক রিলেটেড অ্যাংজাইটি ম্যানেজ করা শিখতে হয়, কিন্তু সব সময় এটি সহজ হয় না।

কেন এই অ্যাংজাইটি হয়?

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটির নানা কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছেঃ

ওয়ার্ক ডিমান্ড

অতিরিক্ত কাজের চাপ, টাইট ডেডলাইন ও বিভিন্ন দায়িত্বের বেরাজালে জর্জরিত হয়ে পড়লে কর্মীর স্কিল ও রিসোর্স নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আটকে যায়। তখন ওয়ার্ক ডিমান্ডের কারণে ব্যক্তি খুব বেশিদূর যেতে পারে না।

জব ইনসিকিওরিটি

চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়, সম্মান কমে যাওয়া বা প্রমোশন না হওয়া এমন নানা কারণ এই অ্যাংজাইটির অন্তর্ভুক্ত।

ওয়ার্কপ্লেস রিলেশনশীপ

কলিগ, সুপারভাইজর বা ক্লায়েন্টের সাথে নেতিবাচক সম্পর্কে দিন দিন স্ট্রেস ও সোশ্যাল অ্যাংজাইটি বাড়াতে থাকে।

অর্গানাইজেশনাল কালচার

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি, আরফাতুন নাবিলা

সাপোর্ট না পেলে বা টক্সিক ওয়ার্ক কালচার হলে অর্থাৎ যেখানে শুধু কম্পিটিশন থাকে, সেখানে ওয়ার্ক রিলেটেড স্ট্রেস বাড়তে থাকে। যে প্রতিষ্ঠানে এই অ্যাংজাইটি বেশি থাকে, সেখানে কর্মীদের ভালো থাকা গুরুত্ব পায় না।

ট্রমা অথবা আগে কোনো নেগেটিভ এক্সপেরিয়েন্স থাকা

যে কর্মীদের আগের কর্মস্থল নিয়ে নেগেটিভ এক্সপেরিয়েন্স যেমন- ডিসক্রিমিনেশন বা ওয়ার্কপ্লেস হ্যারেসমেন্ট থাকে, নতুন জায়গাতে এসেও তাদের দুশ্চিন্তা সহজে কমে না। বরং নানা কারণে ক্রমাগত সেটা বাড়তে থাকে।

পারসোনাল ফ্যাক্টর

ব্যক্তির আগে থেকেই যদি মেন্টাল কন্ডিশন খারাপ থাকে, লাইফে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্ট্রেস থাকে বা ফাইন্যান্সিয়াল কনসার্ন থাকে, তাহলে ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি বাড়তে থাকে।

উপরে যে কারণগুলোর কথা বললাম সেগুলো জায়গা, অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন এ সমস্যায় ভুগছেন কিনা?

একেকজনের কাছে এই সমস্যা একেক রকম। এতে ফিজিক্যাল, ইমোশনাল বা বিহেভিয়ারাল সিম্পটম থাকতে পারে। কীভাবে? চলুন তাহলে ব্যাখ্যা করা যাক-

ফিজিক্যাল সিম্পটম

কর্মক্ষেত্রে যে শারীরিক লক্ষণগুলি দেখা যায়, সেগুলি সাধারণত মানসিক উদ্বেগ থেকেই হয়ে থাকে। তবে এগুলো প্রকাশ পায় বিভিন্ন লক্ষনের মাধ্যমে। যেমন-

  • পেটের সমস্যা
  • অতিরিক্ত ঘাম
  • মাথা ব্যথা
  • মাসল পেইন
  • হার্ট রেট বেড়ে যাওয়া
  • প্যালপিটিশন
  • শ্বাসকষ্টে সমস্যা হওয়া

workplace ansiety, Arfatun nabila

ইমোশনাল সিম্পটম

আপনি যখন স্ট্রেসড হয়ে পড়বেন, তখন বেশ কিছু ইমোশনাল সিম্পতম দেখা দিবে। যেমন-

  • কোনোকিছুতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা
  • খিটখিটে লাগা
  • অতিরিক্ত চিন্তা করা
  • প্যানিক অ্যাটাক হওয়া

কগনিটিভ সিম্পটম

ওয়ার্কপ্লেসে ইমোশনাল ও ফিজিক্যাল সিম্পটম ফেইস করার পর, অনেক কর্মী কগনিটিভ সিম্পটমও ফেইস করতে পারেন। এতে যা যা হয়-

  • মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা
  • চিন্তা বাড়তে থাকা
  • ক্রমাগত কাজের মান কমতে থাকা
  • নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা ভাবতে থাকা

বিহেভিয়ারাল সিম্পটম

আমরা যখন কোনো কারণে স্ট্রেসড হই তখন আমাদের আচরণেও বদল আসে। কিন্তু আমরা অনেকেই সেটা বুঝে উঠতে পারি না। এতে যা যা হয়-

  • আচরণ বদলে গেলে কলিগদের সাথেও কথাবার্তার ধরণ বদলে যায়। তখন কাজে ব্রেক নিতেও ভালো লাগে না।
  • ওয়ার্ক টাস্ক অ্যাভয়েড করতে হয়। যখন কাজ বাড়ে, তখন মনেই হতে থাকে যে স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটি বাড়বে।
  • প্রোডাক্টিভিটি কমতে থাকে।
  • জব, ওয়ার্কপ্লেসের প্রতি ফ্রাস্টেশন শুরু হতে থাকে।

workplaze anxiety, Arfatun nabila

আরও কিছু সিম্পটম

  • ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি হলে ঘুম একদম কমে যায় এবং দেখা দেয় ইনসমনিয়া। অনেকেই সারা রাত জেগে থাকেন, কাজ সংক্রান্ত দুঃস্বপ্ন দেখেন।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বলে প্রায় সময়ই ঠান্ডা লেগে থাকে, ইনফেকশন হয় অথবা অন্য কোনো অসুখ দেখা দেয়। এক সময় এগুলো ক্রনিক স্ট্রেসে পরিণত হয় এবং শরীরের কর্টিসল লেভেল বাড়িয়ে দেয়।

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি বাড়তে থাকলে মেন্টাল হেলথ বা ফিজিক্যাল কন্ডিশন খারাপ হতে থাকে। এমন হলে হেলথকেয়ার প্রফেশনালের সাথে কনসাল্ট করে প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।

কীভাবে কাজে এফেক্ট ফেলে?

কর্মক্ষেত্রে আপনার দুশ্চিন্তা যত বাড়বে, তত কাজের প্রতি বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে যে যে সমস্যা হতে পারে-

জব পারফরম্যান্স খারাপ হবে

আপনি যদি ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি তে ভুগতে থাকেন, তাহলে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে, কাজে ফোকাস করতে এবং কাজ সম্পন্ন করতে সমস্যা হবে। আর এটি প্রভাব ফেলবে ওয়ার্ক পারফরম্যান্সে।

অনুপস্থিতির হার বাড়বে

এই সমস্যা হওয়া মানে চাকরিতে অনুপস্থিত থাকার আগ্রহ বাড়তে থাকা। সরাসরি এমন কারণ যদি নাও হয়, তবু ব্যাপারটি অন্যভাবে ঘটতে পারে। যেমন- কাজ করতে যেয়ে আপনি স্ট্রেসড থাকেন বলে আপনার শরীর ভালো থাকে না, অসুস্থ থাকেন। আর এ কারণে আপনাকে সিক লিভ নিতে হয়।

ফিজিক্যাল হেলথ প্রবলেম

যে কোনো ক্রনিক ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি শারীরিকিভাবে আপনাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এই সমস্যা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে হজমে সমস্যা, হার্ট ডিজিজ ও হাই ব্লাড প্রেশার দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তাছাড়া স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণের পরিমাণও বাড়তে থাকবে, শারীরিক যে কোনো অসুখকে বাড়িয়ে দিবে অল্প সময়ের মধ্যে।

সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে

কর্মক্ষেত্র নিয়ে যদি দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে, তাহলে কাজের আগ্রহ কমবে এবং মেন্তাল চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকবে। দিনশেষে কর্মক্ষেত্রে সহকর্মিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে। এতে সবাই মিলে একসাথে যে কোনো কাজ করতে গেলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জব স্যাটিসফেকশন কমবে

আপনি যে কারনেই কর্মক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা করুন না কেন, দিনশেষে জব স্যাটিসফেকশন কমতে থাকবে। এতে কাজ ভালো করে করতে ইচ্ছা করবে না, মোটিভেশন পাবেন না অথবা কাজে এংগেজ হতে পারবেন না।

Job Satisfaction, Arfatun Nabila

কীভাবে এই দুশ্চিন্তা দূর করা যায়?

ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি দূর করার জন্য কিছু কমন ট্রিটমেন্ট রয়েছে। যেমন-

কগনিটিভ বিভেভিয়ারাল থেরাপি

এটি এমন একটি থেরাপি যেটি আপনার নেগেটিভ চিন্তা বদলে দিবে এবং দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করবে।

মেডিকেশন

এ ধরনের সমস্যায় সাধারণত হেলথকেয়ার প্রফেশনালরা অ্যান্টি অ্যাংজাইটি মেডিকেশন দিয়ে থাকেন। এটি এক ধরনের থেরাপি।

রিল্যাক্সেশন টেকনিক

ডিপ ব্রিথিং, মেডিটেশন বা প্রগ্রেসিভ মাসল রিল্যাক্সেশন অ্যাংজাইটি দূর করতে খুব ভালো কাজ করে।

এক্সারসাইজ

দুশ্চিন্তা কমিয়ে ভালো থাকার জন্য রেগুলার এক্সারসাইজ করা জরুরি। তাই প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হলেও হাঁটাহাঁটি বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের অভ্যাস গড়ে তুলুন।

কর্মক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা হতেই পারে। কিন্তু এটি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। যদি ওয়ার্কপ্লেস নিয়ে কোনো কথা থাকে, তাহলে আগে ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে হেলথ প্রফেশনালের সাহায্য নিন। যদি একদমই কোনো কিছুতে কাজ না হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠান বদলে ফেলুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *